ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন : রোহিঙ্গারা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে !!
- ডেস্ক রিপোর্ট:
- 23 Jun, 2025
বিবিসি-বাংলা
মিয়ানমারের আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ'। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনের বক্তব্যকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ আবার তাদের প্রতিবেদনের বক্তব্যের সমর্থনে বলেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদার করেছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এমনকি সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোয় যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটি বলছে, পক্ষ দু'টি যুদ্ধে জড়ালে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও নষ্ট হবে। যার ফলে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ তো হবেই, সেইসঙ্গে নতুন করে আরও রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হতে পারে।
'বাংলাদেশ/মিয়ানমার: রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতার ঝুঁকি' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যরা রাখাইন রাজ্যের দখল নেয়। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আরও সংগঠিত হতে শুরু করে। নিজেদের শক্তি বাড়াতে এখন তারা নতুন করে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সমর্থিত আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ধর্মকে ব্যবহার করছে বলেও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ অবস্থায় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা থামানো না গেলে সেটি বাংলাদেশদের জন্য "মারাত্মক ক্ষতি" বয়ে আনবে পারে বলেও সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
তাদের দাবি সত্য হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। "যুদ্ধ শুরু হলে তখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
আরাকান আর্মি সেখানে ঢুকে তাদের প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাতে চাইবে। সব মিলিয়ে বিষয়টি দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকিতে পরিণত হবে," বিবিসি বাংলাকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান।
যদিও বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ক্রাইসিস গ্রুপের অভিযোগগুলোকে অস্বীকার করছেন। "ক্যাম্পে সশস্ত্র তৎপরতা চলছে, ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে–– এগুলো অসত্য কথাবার্তা। উনারা যা বলছেন, সেগুলোর কোনো এভিডেন্স (প্রমাণ) নেই," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
মি. রহমান আরও বলেন, "আমরা সব সময় ক্যাম্পগুলো মনিটর করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। তাদের চোখের সামনে এগুলো ঘটবে, এটা অসম্ভব ব্যাপার।
'জোট বেঁধেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো'
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গ্যানাইজেশনসহ (আরএসও) যত সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তারা সম্প্রতি একজোট হয়েছে।
যদিও অতীতে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোয় তারা নিজেদের মধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। কিন্তু আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাদের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ উত্তর রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকা উচিত বলে মনে করেন গোষ্ঠীগুলোর নেতারা। সেজন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানি থামিয়ে এখন একজোট হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর নেতারা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহিংসতা বন্ধের আশায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও তাদের এই সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। "মনে হচ্ছে, তারা আরাকান আর্মিকে শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার একটি উপায় হিসেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে। তারা গোষ্ঠীগুলোকে সরঞ্জাম দিয়ে কোনো সহায়তা দিচ্ছে কি-না, তা এখনো স্পষ্ট নয়," প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ঘিরেএসব অভিযোগ বা বক্তব্যকেও ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করছে। তবে ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ায় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাস্তবে সহিংসতাও আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে গেছে। কিন্তু তাতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা থেমে নেই, বরং আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।
সদস্য সংগ্রহে ধর্মের ব্যবহার বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মাঝেমধ্যেই রক্তপাত ঘটানোয় আগে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোরকে সমর্থন দিতো না সাধারণ রোহিঙ্গারা। ফলে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হতো তাদের। কিন্তু এখন গোষ্ঠীগুলো কৌশল বদল করেছে বলে জানাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ।
নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে 'অস্ত্র' হিসেবে তারা এখন ধর্মকে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযানকে "অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ" হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এতে শরণার্থী শিবিরগুলোকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংগ্রহের "উর্বর ক্ষেত্রে" পরিণত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে গবেষণা সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে আরাকান আর্মি যখন রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে, তখন সংখ্যায় কম থাকা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিজেদের শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা পুরুষদেরকে তারা জোর করে আধা-সামরিক ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করে।এছাড়া রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা সরকার একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
যদিও ওই গোষ্ঠীগুলোই তার আগে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছিল। কিন্তু সমঝোতার পর রোহিঙ্গাদের গোষ্ঠীগুলোর একটি অংশ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সম্মত হয়। যদিও তখনও রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি।কিন্তু রাখাইন রাজ্যের দখল নেওয়ার পর উত্তর রাখাইনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির নেতাদের অনেকে এমন কিছু বিতর্কিত বক্তব্য দেন, যা আরাকান আর্মিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রভাবিত করে। এর মধ্যেই মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সমর্থিত আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচয়কে সামনে আনার কৌশল নিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতারা।
'মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে'
বাংলাদেশে বর্তমানে যে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থান করছে, তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটির সরকার। গত কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানো হলেও আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। "এর মধ্যেই রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির ওপর হামলা শুরু করেছে এবং সীমান্তের শিবিরগুলোতে যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই সশস্ত্র তৎপরতা আরও তীব্রতর হলে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক, আরাকান আর্মি এবং বাংলাদেশ, সবপক্ষের জন্যই মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে," প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ।
সংস্থাটির মতে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এরপরও গোষ্ঠীগুলো সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তেমনি মিয়ানমারেও রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব আরও বেড়ে যেতে পারে। "এতে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে আরও রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াবে এবং সেই সংঘাত থেকে বাঁচতে সেখানকার রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে।
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
সর্বাধিক পঠিত সংবাদ
