• ডেস্ক রিপোর্ট:
• 01 May, 2025

অপারেশন কক্ষে চিকিৎসক বসে থাকবেন। তাঁর হাত থাকবে কম্পিউটারের বোতামে। সঙ্গে থাকবে ভিডিয়ো গেমের জয়-স্টিকের মতো একটি কন্ট্রোল সিস্টেম। তিনিই দূর থেকে চালনা করবেন একটি যন্ত্রকে। সেই যন্ত্রই তার হাতগুলি নেড়েচেড়ে রোগীর শরীরে ছুরি-কাঁচি চালাবে। চিকিৎসক কেবল নির্দেশ দিয়ে যাবেন।
গল্প নয়, বাস্তবেই হচ্ছে এমন অস্ত্রোপচার। চিকিৎসার পরিভাষায় যার নাম ‘রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি’ অর্থাৎ, রোবট দিয়ে অস্ত্রোপচার। যত রকম আধুনিক ও উন্নত অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি এসেছে, তাদের মধ্যে তালিকায় একেবারে প্রথমেই রয়েছে রোবটিক সার্জারি। অনেকেই দ্রুত আরোগ্য লাভের আশায় রোবোটিক সার্জারি করাতে চাইছেন। তবে বিষয়টি অনেকের কাছে এখনও পরিষ্কার না থাকায় মাঝেমধ্যে ভয়ও পাচ্ছেন কেউ কেউ। চিকিৎসককে ভরসা করার অভ্যাস আছে, রোবটকে ভরসা করা তো নতুন অভ্যাস তৈরি করার মতো। তার আগে কয়েকটি বিষয় জেনে নেওয়া জরুরি।

রোবটিক সার্জারি আসলে কী?
হাত-পা নেড়ে চলা কোনও রোবট কিন্তু আসলে অস্ত্রোপচার করে না। করেন চিকিৎসকেরাই। রোবটিক সার্জারি বলে ইন্টারনেটে খুঁজলে ছবিতে যে লম্বা লম্বা হাতবিশিষ্ট যন্ত্রটি দেখা যায়, সেটিই হল রোবট। তার হাতগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে রোগীর শরীরে অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক নিজেই। অর্থাৎ, বিভিন্ন অস্ত্রোপচারে যেমন নানা ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, এ ক্ষেত্রে সেই যন্ত্রটি হল একটি রোবট। 
কী ভাবে হয় অস্ত্রোপচার?

এই যন্ত্রের একটি ‘চোখ’ আছে, যা দিয়ে থ্রি-ডি বা রোগীর শরীরের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শিরা-উপশিরার খুব স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যায়। যন্ত্রের চোখ দিয়ে দেখলে চিকিৎসক রোগীর শরীরের ভিতরের অংশগুলি প্রায় ৪০ গুণ বেশি বড় করে দেখতে পারেন। এমনই জানালেন চিকিৎসকরা। তারা জানালেন, “রোগীকে অচৈতন্য করে অপারেশন রুমের কনসোলে বসেন সার্জন। তার পর তিনিই চালান যন্ত্রটিকে। মনিটরে চোখ রেখে রোবটের হাতগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেন চিকিৎসকই। ওই যন্ত্রের মাধ্যমে দেহে ক্ষুদ্র কয়েকটি ফুটো করে অস্ত্রোপচারের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যায় টেলিস্কোপিক ক্যামেরা। সঙ্গে ক্যামেরা, ছুরি, কাঁচি, সুচের মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। সার্জারির জায়গার কাটা-ছেঁড়া, সেলাই সবই হয় রোবটের হাত দিয়ে।” 

রোবটের হাত আর চিকিৎসকের মগজাস্ত্র

রোবটিক সার্জারি ব্যাপারটি অনেকটা ভিডিও গেমের মতো। দূর থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে রোবটটিকে চালনা করেন চিকিৎসক নিজেই। রোবটের সীমাবদ্ধতা হল, তার মস্তিষ্ক নেই, তবে যান্ত্রিক দক্ষতা আছে, আর চিকিৎসকের আছে মগজাস্ত্র। দুয়ের মিলমিশেই জটিল থেকে জটিলতর অস্ত্রোপচারে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছেন চিকিৎসকেরা। বিষয়টি আরও একটু খোলসা করে বললেন কলকাতার হাসপাতালের ইউরো-অঙ্কোলজিস্ট এবং রোবোটিক সার্জন কুমার গৌরব। অপারেশন থিয়েটরে ঢুকে সার্জন কনসোলে বসার পরে রোবটটিকে আগে রোগীর শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়। তার জন্য অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার থাকে। এ বার যে জায়গায় অস্ত্রোপচার হবে, সেখানে রোবটিক পোর্টগুলি ডকিং করা হয়। এই পোর্টের মাধ্যমেই রোবটের হাত শরীরে ঢুকে অস্ত্রোপচার করে। চিকিৎসক তখন গোটা সিস্টেমটি কন্ট্রোল করবেন। ধরা যাক, পেটের ভিতর অস্ত্রোপচার হবে। সার্জন ঠিক যে ভাবে ছুরি-কাঁচি ধরে পেটের ভিতরে হাত ঢোকাবেন, যে ভাবে হাত নাড়াবেন, তিনি কনসোলে বসে ঠিক তেমনই করবেন। রোবটের হাত সেটি অনুসরণ করে অস্ত্রোপচারটি করবে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মাস্টার-স্লেভ টেকনিক’। মালিক হলেন চিকিৎসক নিজে, ক্রীতদাস হল রোবট। চিকিৎসকের কথামতো তাঁর পদ্ধতি মেনে চলাই হল রোবটের কাজ
হার্নিয়া থেকে হার্ট— কেরামতি দেখাচ্ছে রোবট?

১৯৮৫ সালে নিউরোলজিক্যাল বায়োপসি করতে প্রথম রোবটের সাহায্য নেওয়া হয়। এর পরে ২০০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য ভিঞ্চি’ নামে একটি সংস্থা এই রোবট বাজারে আনার পরে চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। কোন কোন অস্ত্রোপচার রোবট দিয়ে করা সম্ভব তার গাইডলাইন দিলেন চিকিৎসকরা।
 ১) হার্নিয়া, পিত্তথলির পাথরের অস্ত্রোপচার রোবট দিয়ে করা সম্ভব।

২) হার্টের অস্ত্রোপচার রোবট দিয়ে করছেন চিকিৎসকেরা।

৩) থোরাসিক ও থাইরয়েডের অস্ত্রোপচার হচ্ছে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড পদ্ধতিতে।

৪) ইউরোলজিতে কিডনি ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসার, টেস্টিকিউলার ক্যানসারের সার্জারি রোবট দিয়ে করা সম্ভব।
৫) গাইনোকলজিতে হিস্টেরেকোটমি, ওভারিয়ান সিস্টেকটোমিস, এন্ডোমেট্রিওসিস, গাইনেকোলজিক ক্যানসার সার্জারি রোবট দিয়ে হচ্ছে।

হাঁটু প্রতিস্থাপনও রোবট দিয়ে হবে?

শতাধিক হাঁটু প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার রোবট দিয়ে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থোপেডিক সার্জনরা। সার্জারির আগে রোগীর সিটি স্ক্যান করে হাঁটুর ৩-ডি রেখচিত্র বার করা হয়। এই ছবি দেখেই ডাক্তারেরা বুঝতে পারেন, হাঁটুর কোন অংশে ক্ষয় হচ্ছে, অস্ত্রোপচার করতে হবে ঠিক কোন জায়গায়। কম্পিউটারে সেই রেখচিত্রের ৩-ডি মডেল বার করে অস্ত্রোপচারের পুরোটাই আগাম ম্যাপিং করে নেওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যেই রোগী স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন, যা গতানুগতিক অস্ত্রোপচারে সম্ভবই নয়।
বাইপাস সার্জারিতেও রোবট

যে কোনও ওপেন সার্জারিই রোবট দিয়ে করা সম্ভব। বাইপাস সার্জারি রোবট দিয়ে নিখুঁত ভাবে করা যায় বলেই জানালেন কার্ডিয়াক সার্জনরা। রোবটিক কার্ডিয়াক, করোনারি বাইপাস, ভাল্ভ রিপ্লেসমেন্ট সবই রোবট দিয়ে করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এমনকি, হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারিও হচ্ছে রোবট দিয়েই।

ক্যানসারের চিকিৎসায়

স্তন ক্যানসার, জরায়ুর ক্যানসারের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি। বিশিষ্ট সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট শুভদীপ চক্রবর্তী জানালেন, শহরের অনেক রোগীই এখন ক্যানসারের চিকিৎসায় রোবটিক সার্জারিরই দ্বারস্থ হচ্ছেন। এতে সুবিধা অনেক— ১) ক্যানসার আক্রান্ত রক্তজালিকাগুলিকে চিহ্নিত করা যায় ২) সার্জারির সময়ে রক্তপাত কম হয় ৩) স্নায়ুর ক্ষতি হয় না ৪) অস্ত্রোপচারের পরে রোগীকে যন্ত্রণা সইতে হয় না ৫)ক্যানসার আক্রান্ত গ্রন্থিগুলিকে সহজেই বার করে আনা যায়।
রোবটিক সার্জারির সুবিধা অনেক

১) কাটাছেঁড়া না করেই সার্জারি করা সম্ভব, এতে রোগীর শরীরে ক্ষতের দাগ থাকে না।

২) অস্ত্রোপচারের পরদিনই রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় রোগী ঘোরা, বেড়ানো, গাড়ি চালানো সবই করতে পারেন।

৩) জটিল অস্ত্রোপচারের সময়ে চিকিৎসকের হাত কাঁপতে পারে, কিন্তু যান্ত্রিক হাতের ফিল্টারে কখনও কম্পন হবে না। ফলে অস্ত্রোপচার ত্রুটিহীন হবে।

৪) টানা ৭-৮ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার চিকিৎসককে দাঁড়িয়ে করতে হবে না। রোবট দিয়ে একটানা সার্জারি করা সম্ভব।

৫) এক জন বয়স্ক অভিজ্ঞ সার্জন ক্লান্ত না হয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্ত্রোপচার করতে পারবেন, যা হয়তো শারীরিক ভাবে তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না।

৬) সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রোবটিক হাত খুব উপযোগী, যেখানে মানুষের আঙুল পৌঁছোনো বা ল্যাপরোস্কপি করা বেশ কঠিন। রোবটিক হাতের আঙুলে একাধিক জয়েন্ট থাকায় অনেক দিকে ঘোরানো সম্ভব। শরীরের যে সব অংশে মাংস, রক্তজালিকার স্তর ভেদ করে চিকিৎসকের হাত পৌঁছোতে পারে না, সেখানে অবলীলায় পৌঁছে যাবে যান্ত্রিক হাত। সেলাইও হবে নিখুঁত।

৭) রোগীর রক্তক্ষরণ ও যন্ত্রণা কম হয়, হাসপাতালে থাকার মেয়াদও কমে যায়। অস্ত্রোপচার পরবর্তী সমস্যাগুলি হয় না, ফলে রোগী তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।